আদম এবং ইবলিস: এক যুগের শিক্ষা
আসুন, মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু করি। তখন, মালাইকাগণ আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন, তারা সবসময় আল্লাহর ইবাদত করে চলছিলেন। আল্লাহ জ্বীন জাতিকেও সৃষ্টি করেছিলেন, যার একজন সদস্য ইবলিসও ছিল, এবং সে দীর্ঘ বহু বছর ধরে আল্লাহর ইবাদত করছিল। তো, একসময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা মানুষের সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মালাইকাগণের সাথে আলোচনা করেন, এবং মালাইকাগণ বলেন, "হে আল্লাহ, আমাদের তো সবকিছুই আছে, কিন্তু মানুষ তো মাটি থেকে তৈরি, তারা তো আর সঠিকভাবে ইবাদত করবে না, পৃথিবীতে অশান্তি করবে, রক্তপাত করবে।" আল্লাহর উত্তরে তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।”
তাহলে, আসুন দেখি আদম (আঃ) কেন এমন গুরুত্বপূর্ণ। আদমের এমন কোন বিশেষ গুণ ছিলো, যা অন্যদের মধ্যে ছিল না? কেন আল্লাহ আদমকে এত সম্মান দিয়েছেন?
আল্লাহ যখন আদমকে সৃষ্টি করলেন, তখন সব মালাইকা এবং ইবলিসকে আদমকে সিজদাহ করতে নির্দেশ দেন। মালাইকাগণ এই নির্দেশ পালন করলেও, ইবলিস সিজদা করতে অস্বীকার করে। কারণ সে ভাবতো, “আদম তো মাটি থেকে তৈরি, আর আমি তো আগুন থেকে সৃষ্টি, মাটির তৈরি কাউকে সিজদা করে সম্মান দিতে কি ঠিক হবে?”
আল্লাহ যখন ইবলিসকে প্রশ্ন করেন কেন সে আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছে, ইবলিস তখন আল্লাহর আদেশ অমান্য করে যুক্তি প্রদর্শন করে এবং তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে।
এখন আসুন দেখি আদম (আঃ) কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
আল্লাহ আদম (আঃ)-কে জান্নাতে থাকার নির্দেশ দেন, কিন্তু একটি গাছের ফল খেতে নিষেধ করেন। আদম (আঃ) তার স্ত্রী হাওয়া (আঃ)-এর সাথে জান্নাতে ছিলেন, কিন্তু একসময় ইবলিসের প্ররোচনায় আদম (আঃ) সেই গাছের ফল খেয়ে ফেলেন। কিন্তু এর পর, আদম (আঃ) যেমন তাঁর ভুল স্বীকার করলেন, তেমনি ইবলিস তা করেননি।
আদমের পক্ষে তাঁর একমাত্র অনুতপ্ত এবং মাফ চাওয়ার প্রক্রিয়া ছিল এমন: “হে আমাদের রব, আমরা তো ভুল করেছি, আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন, তবে আমরা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।” [সূরা আরাফ (৭): ২৩]
এবং দেখুন, ইবলিস কী বলেছিল? আল্লাহ যখন ইবলিসকে প্রশ্ন করেন, “তুমি কেন সিজদা করো না?” তখন ইবলিস বলে, “আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে আর তাকে মাটি থেকে তৈরি করেছেন।”
এখানে কি কোন তফাৎ দেখতে পাচ্ছেন? ইবলিস কি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারতো না? কিন্তু ইবলিস তার আত্মবিশ্বাস এবং অহংকারের কারণে আল্লাহর আদেশ অগ্রাহ্য করে যুক্তি দেখিয়েছে।
অন্যদিকে, আদম (আঃ) তার ভুল স্বীকার করে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি নিজের ভুলকে নিজের কাঁধে নিয়েছেন, এবং তাঁর স্ত্রীর দোষ দিয়ে দেননি। আদম (আঃ) ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা মাফ প্রাপ্তির সময় একসাথে তাঁর স্ত্রীর সহিত তাঁকে মাফ করার ইচ্ছা প্রकट করে।
আদমের এই বিনয়ী মনোভাব সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে ভুল হলে সেই ভুল স্বীকার করে বিনয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। যদিও ইবলিসের আমল ছিলো অনেক উঁচু, কিন্তু তার অহংকার তাকে পতিত করেছে। আদম বিনয়ী হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তাঁকে মাফ করে দিয়েছেন।
আল্লাহ চান না যে আমরা পারফেক্ট হই, বরং তিনি চান যে আমরা যখন ভুল করি, তখন আমাদের হৃদয়ে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। যদি আমরা নিজেদের অহংকার দূর করতে পারি এবং আল্লাহর সামনে নিজেদের ছোট ভাবতে পারি, তাহলে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
ইবলিস এবং আদমের ঘটনা থেকে যে শিক্ষাটি পাওয়া যায় তা হলো, আমাদের পারফেক্ট হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং আমাদের আচরণ এবং বিনয়টাই আল্লাহর কাছে মূল্যবান। আল্লাহ আমাদের মাঝে ভুল করার ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি চান যে আমরা সেই ভুলের পর অনুতপ্ত হয়ে, বিনয়ী হয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাই।
আমাদের ইবাদত ঠিক থাকলেও, আমাদের ভুলে যাওয়া এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এটি পরিপূর্ণ ইবাদত, যা আমাদের আত্মাকে বিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর কাছে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
আজই আমাদের সকল ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তওবা করি এবং চেষ্টা করি ভুলের পুনরাবৃত্তি না করতে।